অমল কৃষ্ণ পালিত, যশোর প্রতিনিধি: ১৪ই ডিসেম্বর ২০২২ বুধবার, হেমন্তের শেষ সকালটা ছিল ঘন কুয়াশায় মোড়া। সেই কুয়াশার চাদর ভেদ করে ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। তবু যশোরের পথে পথে ছিল ফুল আর নিজ নিজ সংগঠনের ব্যানারে মানুষের সরব পদচারণা। সব জনস্রোতের মোহনা যশোরের চাঁচড়ার বধ্যভূমিতে। মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ আর ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে স্লোগান মুখর ঝাঁঝালো মিছিল নিয়ে সমেবত হচ্ছিলেন যশোরবাসী। ও পাশে সার গোডউন মোড় আর এ পাশে সরকারি মুরগীর খামারের সামনে নিরাপত্তায় বসেছিল পুলিশ প্রহরার ব্যারিকেড। তার পাশ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে যারা আসছিলেন সবার কণ্ঠে অনুপ্রণিত হয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রেখে যাওয়া আদর্শ ও পথকে অনুসরণ করে একটি অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার শপথ।

বুধবার সকাল আটটায় চাঁচড়া শহীদ বেদিতে পুস্প স্তবক অর্পণ করে দিবসের কর্মসূচি শুরু করেন যশোর জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ শ্রদ্ধা জ্ঞাপণ করেন। এরপর জেলা পুলিশের পক্ষে পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদারের নেতৃত্বে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন।

এরপর পর্যায়ক্রমে চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুলের নেতৃত্বে জেলা পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আলম ও এ এইচ এম মুযহারুল ইসলাম মন্টুর নেতৃত্বে বীরমুক্তিযোদ্ধাগণ, জেলা কমান্ডান্ট সনজয় কুমার সাহার নেতৃত্বে আনসার ও গ্ৰাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা একেএম গোলাম আজমের নেতৃত্বে জেলা শিক্ষা অফিস, ডেপুটি সিভিল সার্জন ডাক্তার নাজমুস সাদিকের সিভিল সার্জনের কার্যালয়, নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলামের নেতৃত্বে গণপূর্ত বিভাগ, সহকারী পরিচালক সালেহ উদ্দীনের নেতৃত্বে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস শ্রদ্ধা জানান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা সাধন কুমার দাস ও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক আহসান হাবীব পারভেজ।

এরপর একে একে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড যশোর, শংকরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যশোর জিলা স্কুল, প্রাণী সম্পদ বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, যশোর কলেজ, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, আইডিইবি, জেলা জাসদ, হোমিও চিকিৎসক ও পেশাজীবী সংগঠন, যশোর পল্লী বিদ্যুত সমিতি-১, আমিনিয়া কামিল মাদ্রাসা, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যশোর সরকারি মহিলা কলেজ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যশোর জেলা, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর,

বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, জেলা পরিসংখ্যান অফিস, স্বপ্ন দেখো, মাইকেল মধুসূদন ডিবেট ফেডারেশন, যশোর বিজ্ঞাণ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দুইশ’ ৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), সরকারি সিটি কলেজ, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বাম গণতান্ত্রিক জোট, বাংলাদেশ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, অগ্নিবীণা কেন্দ্রিয় সংষদ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যবিপ্রবি শাখা, ডাক্তার আব্দুর রাজ্জাক মিউনিসিপ্যাল কলেজ, রাঙা প্রভাত, জেলা বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, সম্মিলিত সাংষ্কৃতিক জোট, শিল্পকলা একাডেমি, প্রথম আলো বন্ধু সভা, যশোর মেডিকেল কলেজ, যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিটিউট, থিয়েটার ক্যানভাস, যশোর পৌরসভা, দৈনিক প্রতিদিনের কথা,

কাজী নাবিল আহমেদের পক্ষে নেতৃবৃন্দ, মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী, জেলা যুবলীগ, ব্যাঞ্জন যশোর, সরকারি এম এম কলেজ, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামীলীগ যশোর জেলা শাখা, জেলা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠন, বঙ্গবন্ধু সাংষ্কৃতিক জোট, প্রেসক্লাব যশোর, জেলা সংবাদ পত্র পরিষদ, যশোর জেলা সাংবাদিক ইউনিয়ন, যশোর সাংবাদিক ইউনিয়ন (জেইউজে), বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, জেলা ছাত্র মৈত্রী, যুব মৈত্রী, বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টি, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, জেলা কৃষকলীগ শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে কোরআন থেকে তেলওয়াত করেন কালেক্টরেট মসজিদের মোয়াজজিন ক্বারী রফিকুল ইসলাম। গীতা পাঠ করেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের উপপ্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রবীর কুমার সরকার, এবং বাইবেল থেকে পাঠ করেন ধর্মতলা এজি চার্চের পুরোহিত আগাস্টিন মানিক গাটিয়া। ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে পাঠ শেষে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে তিন ধর্মগুরুর একান্ত আলাপচারিতা অসাম্প্রাদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি উঠে আসে। বধ্যভূমিতে আগত সকলের কণ্ঠেই প্রতিধ্বণিত হয় ঐক্যবদ্ধ হয়ে একাত্তরের ঘাতক, মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীচক্র এবং যেকোনো অপশক্তির ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার।

মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য চক্রান্ত করে। তারা তাদের এ দেশীয় দোসরদের নিয়ে শিক্ষক, বিজ্ঞানী, চিন্তক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, ক্রীড়াবিদ, সরকারি কর্মকর্তাসহ বহু মানুষকে হত্যা করে। বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পর রাজধানীর রায়েরবাজার ইটখোলা ও মিরপুরের বধ্যভূমিসহ ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের চোখ-হাত বাঁধা ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায়।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রেখে যাওয়া আদর্শ ও পথকে অনুসরণ করে একটি অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে পারলেই তাঁদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে। তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের ত্যাগ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

দল-মত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একাত্তরের ঘাতক, মানবতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধী জামাত-মৌলবাদীচক্র এবং গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির যেকোনো চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।